বাজরিগার পাখি পালনের জন্য কিছু পরামর্শ




আমার বাসায় প্রায় ২০ জোড়া বাজরিগার পাখি আছে। শখের বশেই পাখি পালা শুরু করি। প্রথমে চারটি মানে দুই জোড়া পাখি ছিল এবং এরা আলাদা আলাদা ব্লাড লাইন থেকে আসা পাখি। ফলে বাচ্চাগুলাও বেশ হেলদি, চটপটে আর সাইজে বড় হচ্ছিলো।
কিন্তু বিপত্তি হল যখনি আমি দ্বিতীয় প্রজন্মের বাচ্চাগুলাকে ব্রিডিং করাতে গেলাম। অজ্ঞতাবশতঃ আমি ভাই বোনের মধ্যে জোড়া দিয়ে দেই, ফলে দেখলাম চারটি বাচ্চা ফুটলে অন্তত দুটি বাচ্চা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মাচ্ছে। অন্য বাচ্চাগুলাও দুর্বল আর ছোট হচ্ছে। কিন্তু আমি এর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেকগুলা বাচ্চার ডানা, পা বাঁকানো। কেউ আবার উড়তে পারে না।
আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরে বুদ্ধি করে একবার পেয়ার চেঞ্জ করে দিলাম, দেখলাম এবার বাচ্চা ঠিক আছে। লক্ষ্য করলাম এদের ব্লাড লাইন ভিন্ন। অর্থাৎ এরা ভাই-বোন বা নিকটাত্মীয় নয়। বুঝতে পারলাম একই রক্তের মধ্যে পেয়ার দিলে বাচ্চা এমন বিকলাঙ্গ আর দুর্বল হয়।
এখন আমার ৫ জোড়া পাখি নিয়মিত ডিম-বাচ্চা দিচ্ছে। এর মধ্যে মাস্টার পেয়ার আছে তিন জোড়া। এবার আবার ভুলক্রমে মামা এবং ভাগনির মধ্যে একটা পেয়ার দিয়ে আজ দেখলাম একটা বিকলাঙ্গ বাচ্চা জন্মেছে।
এখন ঠিক করলাম প্রতিটি পাখির ছবি সহ একটি প্রোফাইল তৈরি করবো। যাতে ভবিষ্যতে একই ব্লাডলাইনের মধ্যে পেয়ার না হয়ে যায়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা শিখলাম, সেটা সবার সাথে শেয়ার করলাম।
আপনারা যারা নতুন বাজরিগার পাখি পালক বা পুষবেন বলে চিন্তা ভাবনা করছেন তাদের জন্য কিছু নিচের কিছু গুরুত্বপূর্ন পরামর্শ জেনে রাখা দরকার।প্রথমে আপনার মনকে স্থির করুন। 
  1. পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কথা বলুন এবং তাদের মতামত নিন। 
  2. পরিবারের সম্মতি থাকলে তাহলে পাখি কিনুন, কেননা মাঝে মাঝে তাদের সাহায্য আপনার প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া বাজরিগার পাখি অনেক অনেক ডাকাডাকি করে। পরিবারের সম্মতি না থাকলে আপনাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতে পারে। 
  3. কয়েকজন পাখি পালকের সাথে কথা বলুন। তারা কিভাবে পাখি পালে তা লক্ষ্য করুন। তাদের সাথে সুবিধা ও অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করুন। 
  4. পাখি পালন করতে গিয়ে আপনি যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হবেন, তা মোকাবেলা করার জন্য কতটুকু প্রস্তুত তা যাচায় করুন। 
  5. প্রাথমিক অবস্থায় লাভের চিন্তা করবেন না। আগে পাখি সুস্থভাবে পালন করা শিখুন তারপর অন্য চিন্তা করুন। 
  6. ডিম বাচ্ছার লোভে পাখি পালার কথা চিন্তা করবেন না। এদের সঠিকভাবে যত্ন করলে নিজ থেকে এরা আপনাকে আনন্দে ভরিয়ে দিবে। 
  7. বাজরিগা পাখি কেনার আগে পাখি রাখার জন্য যতাযথ স্থান এবং খাচার ব্যবস্থা করুন। 
  8. প্রথমে ২ জোড়া কম বয়সী পাখি কিনুন, ছেলে মেয়ে পাখিকে আলাদা রাখুন। বাজরিগার পাখির বয়স সর্বনিম্ন ৮ মাস হলে ব্রীডিং অবস্থায় আসলে ছেলে মেয়ে পাখিকে একসাথে দিন। মনে রাখবেন, সঠিক নিয়মে পাখি পালন না করলে এরা আপনার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
১ স্থান নির্বাচনঃ
সবার আগে আপনি পাখিদের কোথায় রাখবেন তা নির্ধারন করতে হবে। আলো-বাতাস পূর্ণ নিরিবিলি স্থান সবচেয়ে ভাল। তবে সরাসরি সূর্যের তাপ ও বাতাস গায়ে লাগা থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
২ খাঁচা নির্বাচনঃ
বাজরিগার পাখি পালনের জন্য আপনার সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় খাঁচা নির্বাচন করুন। খাচার ভিতর পাখি যাতে ডানা মেলে উড়তে পারে, এক লাঠি থেকে অন্য লাঠিতে উড়ে যেতে পারে, খাঁচা বেয়ে উঠতে পারে এবং খেলাধুলা করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। খাঁচার ভিতর ২টি ভিন্ন মাপের কাঠি দিন যাতে তাদের পায়ের ব্যায়াম হয়। একজোড়া বাজরিগা পাখির প্রজনের জন্য কমপক্ষে ১৮ ইঞ্চি X ১৮ ইঞ্চি X ১৮ ইঞ্চি মাপের খাঁচা ব্যবহার করা ভাল।

খাবার বিষয়ে কর্তব্য
প্রতিদিন খাবারের তালিকায় থাকবে চিনা-কাউন সমপরিমাণ। অল্প পরিমাণ সূর্যমুখীর বীজ, তিসি, গুজিতিল, কুসুম ফুলের বীজ ও পোলাওয়ের চালের ধান। অথবা পাখির খাবারের দোকানে সিড মিক্স পাওয়া যায়।
সপ্তাহে তিনদিন কলমি শাক বা পালন শাক দিন। ধান ও কলমি শাক চর্বি কাটাতে ও প্রজননে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে পানি বদলান ভালো। খাবারের অপচয় কমাতে প্রতিদিন না হলেও একদিন পর পর সকাল বেলায় খাবারের তুষ ফেলে দিয়ে নতুন খাবার মিশিয়ে দিতে হবে।
পাখি রেখে বেড়াতে যাবেন কোন সমস্যা নাই। এক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। পানি নষ্ট হবে না এরকম ফিল্টার পদ্ধতি পাবেন পাখি কেনা-বেঁচার দোকানে। ফুটন্ত পানি ১০ দিনের বেশি পর্যন্ত চলবে। দাম খুব বেশি নয় প্রতিটি ২০ টাকা।
যারা বাণিজ্যিকভাবে পালন করেন বা করবেন তাদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে যত্ন নিতে হবে। কারণ এতে খরচ কম হবে। যদি পাখির ওজন বেড়ে যায় তবে পোলাওয়ের ধান খাওয়ালে খরচ বেশি হবে। যত্নে থাকলে এই পাখির অসুখ হয় না বললেই চলে। তাছাড়াও আজকাল ফেইসবুকে সমস্ত বিষয়ে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবেন।
লালন পালন
ব্রিডিং উপযোগী খাঁচার দাম সর্বোচ্চ ৩শ’ টাকা। একজোড়া পাখি দিয়ে সফলতা আসার সম্ভাবনা কম। তাই প্রথমে কমপক্ষে দুইজোড়া পাখি দিয়ে শুরু করলে ভালো। দুটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী পাখি নিয়ে দুই জোড়া পাখির বয়স তিন থেকে চারমাসের মধ্যে হলে ভালো। তিন বা চার মাস বয়সের দুইজোড়া পাখির দাম ১ হাজর থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকার মধ্যে।
প্রথমে একটি খাঁচার মধ্যে শুধু পুরুষ পাখি কমপক্ষে ছয় থেকে সাত মাস বয়স পর্যন্ত রাখুন। অপর আরেকটি খাঁচায় শুধু স্ত্রী পাখিও সেভাবেই রাখুন। এবার জোড়া মিলিয়ে দুই খাঁচায় দিন।খাঁচায় দেওয়ার এক থেকে দুই মাসের মধ্যে হাঁড়ি ঝুলাবেন খাঁচার এক কোণে। বসার লাঠির একপ্রান্ত হাঁড়ির মুখের কাছাকাছি হতে হবে। যাতে সহজেই লাঠি থেকে হাঁড়িতে ঢুকতে পারে। ছোট লাঠি দেওয়া যাবে না। বসার লাঠি হতে হবে কাঠের বা বাঁশের চটা। লোহা, লোহার পাইপ বা পস্নাস্টিকের পাইপ এ রকম কোনো লাঠি দেওয়া ঠিক নয়। মিনারেল ব্লক, সমুদ্রের ফেনা ও গ্রিড খাঁচাতে দিয়ে রাখবেন। পানির পাত্র থাকবে পাখি বসার থেকে দূরে। আর খাবারের পাত্র হাঁড়ির নিচে থাকলে ভালো। কারণ পাত্রগুলো যেন পাখির মল থেকে নিরাপদ থাকে।
বিক্রি করার উপযোগী পাখি
৩৫ থেকে ৪০ দিন বয়সি পাখি বিক্রি করা যায়। হাট, দোকান বা ফেইসবুকের মাধ্যমে বিক্রি করা যায়।
পাখির খামার, বাসায় পোষেণ, হাট এমন কোনো জায়গা পরিদর্শন করতে পারেন। এতে আপনার আগ্রহ বাড়বে এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।

লাভ বার্ডের পালনে সর্তকতা

১. পাখির খাচায় যেন পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় পাত্র না থাকে । কারন এরা ওদের ধারাল দাত দিয়ে সারাক্ষণ কামড়ায় । কোন কারনে প্লাস্টিক কেটে খেয়ে ফেললে, অসুস্থ বা মারা যেতে পারে । 
২. খাচায় এই পাখি পালন করতে হলে ৩২ x ২০ x ২০ ইঞ্চি একটি খাচায় এক জোড়া পাখি পালন করতে হবে ।
৩. একটি খাচায় তিন জোড়া পাখি থাকলে সবগুলি বাক্স বা কলসি একই উচ্চতায় দিতে হবে । নইলে বাসা নিয়ে মারামারি করে সকলেই আহত হতে পারে হবে ।  
৪. লাভ বার্ড এর পরিপূর্ণ বয়স হতে প্রায় ১০ মাস সময় লাগে, কখনও কখনও ১২/১৩ মাস সময় লাগে ।
৫. এরা সাধারনত ১০/১১ মাস বয়সেই ডিম দেয় । লাভ বার্ডের ডিম দেওয়ার সময় হলে প্রতি জোড়া পাখির জন্য ৮ x ৮ x ৮  মাপের কাঠের বাক্স বা মাঝারি সাইজের পাখির জন্য তৈরি কলসি দিতে হবে।
৬. লাভ বার্ড প্রতিবারে ৫টি থেকে ৮ টি ডিম দিয়ে থাকে । এর মধ্যে সাধারনত ৪ টি বাচ্চা পাওয়া যায়।
৭. ডিম দেওয়ার ২২ – ২৫ দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। ডিম পারার দিন থেকে ৪০ থেকে ৫০ দিন লাগে এদের বাচ্চাদের মুক্ত করে দিতে । এর পরেই এরা আবার ডিম দেওয়ার জন্য তৈরি হয় । মানে বাচ্চা ২০ থেকে ২৫ দিন পাখির বাসার ভিতর থাকে ।
৮. আবহাওয়া অনকূলে থাকলে ও পর্যাপ্ত পরিমান যত্ন নিলে লাভ বার্ড প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর বৎসরে সাধারনত ৪ বার ডিম দেয়।
খাচায় যখন পাখি পালন করা হয় তখন পাখি অনেক ভিটামিন- মিনারেল গ্রহন করতে পারে না । এজন্য পাখি চিকিৎসাকের পরামর্শে ভিটামিন ও মিনারেল অন্যান্য খাবারের সঙ্গে দিতে হবে । 

লাভ বার্ডের রোগ প্রতিরোধ 

১। পাখি উঠানোর আগে খামারসহ ব্যবহার্য্য সকল যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রথমে পানি দিয়ে পানির সাথে কার্যকরী জীবানুনাশক মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
২। সুস্থ্য সবল পাখি সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনে বাহ্যিক পরজীবি নিধনের জন্য ০.৫% ম্যালাথিয়ন দ্রবণে পাখিকে গোসল করিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে পাখির মুখ এই দ্রবণে ডুবানো যাবে না। হাত দিয়ে মাথায় লাগিয়ে দিতে হবে। অন্তঃপরজীবি প্রতিরোধের জন্য কৃমিনাশক ঔষধ সেবন করাতে হবে।
৩। পাখির খোপ, দানাদার খাদ্য ও খনিজ মিশ্রণ সরবরাহের পাত্র, পানির পাত্র ও গোসল করার পাত্র এবং পাখির বসার স্ট্যান্ড নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। জীবাণুমুক্ত খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
লাভ বার্ড পাখি শখের বসে পুষলেও বর্তমানে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে 
Previous Post Next Post

Contact Form